রাজা যায় রাজা আসে, কিন্তু দেশে অনেক কিছুতেই অরাজকতার চেহারা আর বদলায় না। অনিয়মের জায়গাগুলো কখনো শূন্যও থাকে না। কোনো না কোনোভাবে তা পূর্ণ হয়ে ওঠে। হাট, ঘাট, বাজার, ফুটপাত, পরিবহনে চাঁদা, নদী দখল, সরকারি জায়গা-সম্পত্তি দখল—এসবে হাতবদল হয়। কখনোই যেন এসব দখল বা চাঁদামুক্ত রাখা যায় না। একদল বিদায় নিলে আরেক দল সে জায়গা পূরণ করে ফেলে। এসব চাঁদাবাজ বা দখলদার সব সময় সরকারদলীয়। প্রশাসন তাদের সাহায্য করে। কোথাও কোথাও প্রশাসন আর এ সব দখলদার-চাঁদাবাজরা মিলেমিশেই এ কাজ চালিয়ে যায়। পরিবহনে এ অরাজকতার চিত্র ভয়াবহ।
যুগ যুগ ধরে সারা দেশে গণপরিবহন নিয়ে এক অরাজক পরিস্থিতি বহাল রয়েছে। সরকার তাদের দলীয় লোকজনকে অনৈতিক সুবিধা দিতে পরিবহনে সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। যে সিন্ডিকেট বছরের পর বছর সাধারণ যাত্রীদের জিম্মি করে রাখে। শেখ হাসিনা সরকারের বিগত শাসনামলে এই অরাজকতা ভয়াবহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত ২২ অক্টোবর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সরকারের সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান একাই গত ১৫ বছরে পরিবহন খাত থেকে চাঁদাবাজি করেছেন ২৪ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) তাদের এক গবেষণায় বলেছে, বিগত ১৪ বছরে শুধু সড়ক ও মহাসড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজে ২৯ হাজার থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। তারা জানায়, সড়ক ও পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির ব্যাপকতা ও গভীরতা অনেক বেশি। রাজনীতির কাছে এই খাত জিম্মি হয়ে আছে।
শেখ হাসিনা সরকার জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে সব সময় অযৌক্তিকভাবে কিলোমিটারপ্রতি গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করেছে। ভাড়া–নির্ধারণী সভায় সব সময়ই মালিকপক্ষের আধিপত্য বজায় থেকেছে। তারা যেভাবে চেয়েছে, ভাড়া সেভাবেই নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের এ গণবিরোধী নীতির সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষও (বিআরটিএ) জনগণের স্বার্থকে অবজ্ঞা করে বিভিন্ন স্থানের ভাড়া নির্ধারণ করেছে।
নারায়ণগঞ্জে পরিবহন নিয়ে অরাজকতা দীর্ঘদিনের। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিভিন্ন খাতের মতো পরিবহন খাতও ছিল ওসমান পরিবারের চাঁদাবাজির অন্যতম উৎস। যথেচ্ছভাবে ভাড়া বাড়িয়ে জনগণের দুর্ভোগ তৈরিতে স্থানীয় বিআরটিএ ও প্রশাসন সব সময় তাদের সাহায্য করেছে।
২০১১ সালের জুন মাসে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাসভাড়া ২২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩২ টাকা করায় সে সময় নারায়ণগঞ্জে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সে সময় নারায়ণগঞ্জে যাত্রীদের অধিকার রক্ষায় স্থানীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে গড়ে উঠেছিল ‘যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম’। এর কিছুদিন আগে স্থানীয় পরিবহনের মালিকপক্ষ চাঁদা থেকে পরিত্রাণ পেতে স্থানীয় র্যাবকে চিঠি দিয়েছিল। চিঠিতে তারা উল্লেখ করেছিল প্রতি মাসে শামীম ওসমান ও নাসিম ওসমানকে কীভাবে চাঁদা দেওয়া হয়। সে সময় আন্দোলনের মুখে ভাড়া কমিয়ে ২৭ টাকা করা হয়েছিল।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের পরিবহন সিন্ডিকেটের কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন, কেউ–বা গা ঢাকা দিয়েছেন। দেশের পরিবর্তিত বাস্তবতায় এখন নারায়ণগঞ্জের সাধারণ জনতার দাবি উঠেছে, এই পরিবহন সেক্টর যেন আবার অন্য কোনো চাঁদাবাজ বা গডফাদারের হাতে বন্দী হয়ে না পড়ে। জনগণের পকেট কেটে তাদের জিম্মি করে নতুন কোনো গডফাদার যেন আর ফুলেফেঁপে উঠতে না পারে। আর সে জন্যই ৫ আগস্টের পর নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকাসহ সব রুটের ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার এবং শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া দ্রুত কার্যকর করার দাবি উঠেছে।
সে লক্ষ্যে স্থানীয় জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বিআরটিএ, পরিবহন মালিক ও যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের নেতারা যৌথ কয়েকটি সভা করলেও দাবি বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। ২ এপ্রিল ২০২৪ বিআরটিএ নারায়ণগঞ্জ রুটে বাসভাড়া–সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনটি মালিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য হলেও সে প্রজ্ঞাপন মালিকপক্ষ মানেনি। তারা প্রজ্ঞাপনটির বাইরে গিয়ে বছরের পর বছর অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। এটি বন্ধ করার জন্য জেলা প্রশাসন বা বিআরটিএর কোনো ভূমিকা নেই।
প্রজ্ঞাপনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব সাড়ে ১৯ কিলোমিটার দেখিয়ে (২ দশমিক ৩২ টাকা কিলোমিটারপ্রতি) ভাড়া দেখানো হয় ৪৫ টাকা, ফ্লাইওভার টোল ৫ টাকা ও সানারপাড় ইউটার্ন ৩ টাকা দেখিয়ে বলা হয়, এই রুটে মোট ভাড়া ৫৩ টাকা। সে প্রজ্ঞাপনেই আবার বলা হয় যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের ভাড়া হবে ৫৪ টাকা। কিন্তু বাস্তবে নেওয়া হচ্ছে ৫৫ টাকা। প্রজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল থেকে যাত্রী উঠলে ভাড়া ৪৫ টাকা (ফ্লাইওভার ও ইউটার্ন ছাড়া), চাষাঢ়া থেকে উঠলে ৪২ টাকা, নতুন কোর্ট থেকে উঠল ৪০ টাকা, শিবু মার্কেট থেকে ৩৭ টাকা, জালকুড়ি থেকে ৩১ টাকা ইত্যাদি। কিন্তু সব জায়গা থেকেই ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৪৫ টাকা করে।
প্রজ্ঞাপনে মতিঝিল শাপলা চত্বর ঘুরে দূরত্ব দেখানো হয়েছে সাড়ে ১৯ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো বাসই শাপলা চত্বর ঘুরে যাতায়াত করে না। হিসাবমতে বর্তমান দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। ৩০ আগস্ট সরকার ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১ দশমিক ৫০ টাকা এবং পরে শূন্য দশমিক ৫০ টাকা কমালেও ভাড়া কমানোর কোনো উদ্যোগ বিআরটিএ বা প্রশাসন গ্রহণ করেনি। জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ এসব অসঙ্গতি জেনেও তা নিরসনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়ার দীর্ঘদিনের দাবিও রয়েছে অমীমাংসিত।
এমন বাস্তবতায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের ভাড়া ৪৫ টাকা, নারায়ণগঞ্জ থেকে সব রুটে সিএনজি চালিত বাসের ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে কমানো, শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া কার্যকর করা এবং এসি বাসে বিআরটিসি ৬০ টাকা ও বেসরকারি ৬৫ টাকা করার দাবি উত্থাপিত হচ্ছে।
এসব দাবির সঙ্গে ইতিমধ্যে স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন একাত্মতা প্রকাশ করেছে। স্থানীয় বিএনপি, বাম দল ও ইসলামিক দলগুলো একাত্মতা প্রকাশ করেছে। ১৫ নভেম্বরের মধ্যে দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের পক্ষ থেকে। জেলা প্রশাসক নারায়ণগঞ্জের মানুষের গণদাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তা বাস্তবায়ন করবেন বলে নারায়ণগঞ্জবাসী মনে করে।